পরিবর্তন ও ২০১১ বিধানসভা নির্বাচন
-রেস্টোর ডেমোক্র্যাসি
২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে আপামর বাংলা একটা পরিবর্তন চায়। পরিবর্তন চায় বর্তমান নৈরাজ্যের পরিস্থিতির, রাজনৈতিক অস্থিরতার, প্রশাসনিক অপদার্থতার এবং দুর্নীতির। কিন্তু সব থেকে বড় কথা ২০১১ তে মানুষ পশ্চিমবাংলায় একটা সরকারের অস্তিত্ব দেখতে চায়, যার সাধারন মানুষের কথা শোনার মত কান ও হৃদয় আছে।
পরিবর্তন শুধু বাংলার মানুষ বা বিরোধীরা চায় এমন নয়, সিপিএমও চায়। বর্তমানে মানুষের বামফ্রন্ট সরকারকে সরিয়ে দেবার যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব তার পরিবর্তন চায়। তাই ঘুরে দাঁড়ানোর শ্লোগান। আসলে এই শ্লোগান পশ্চিমবাংলার মাটিতে ঘটতে চলা আশু ইতিবাচক পরিবর্তনকে সাবোতাজ করতে চায়। টিকিয়ে রাখতে চায় পার্টি ছত্রছায়য়ায় কব্জি ডুবিয়ে দই খাওয়ার নিরবিচ্ছিন্ন নেপোবাদ। ফুটিয়ে রাখতে চায় দুর্নীতির পাঁক থেকে রস শুষে বেঁচে থাকা জলে ভাসমান আপাত নিষ্কলুষ পদ্মফুল। আস্তিনের নিচে নিশ্চন্তে জড়িয়ে থাকবে হার্মাদরূপি সন্ত্রাসের পদ্মগোখরো।
কিন্তু ভোট সমাগত, তাই শাসকের কন্ঠে আপাততঃ মধুবাক্য ঝড়িবেক। গোপনে প্রস্তুতি চলছে, নির্বাচন পেরোলেই লেঠেলরা নেমে পড়বে ২০০৬-র কায়দায়। ব্যাখ্যা দেওয়া হবে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামে গরিব চাষী ক্ষেত মজুরের ওপর শিল্পায়নের বুলডোজারটির ওপর সম্মতির শিলমোহর দিয়ে দিয়েছেন জনগন। নির্বাচনের মুখে যথাসম্ভব মোলায়েম মুখোশের আড়ালেও তাই বিভিন্ন জায়গায় স্তম্ভিত জনগন খুচরো নেতাদের মুখে আজও শোনে কৃষকের জমি কেড়ে নন্দীগ্রামে, সিঙ্গুরে শিল্পায়ন সঠিক ছিল। না হলে, মধ্যবিত্ত উচ্চমধ্যবিত্ত খুচরো-মাঝারি নেতা নেত্রীদের এমবিএ ইঞ্জিনিয়ার ছেলেমেয়েদের কী হবে? কোথায় তারা চাকরি করবে? বুঝতে অসুবিধা হয় না, একদা সর্বহারার নামাবলী গায়ে চাপানো দলের গণভিত্তি চুপিসাড়ে কোথায় সরে গেছে। কাদের খুশি করতে বহু খুন-গুমখুন-ধর্ষন-অত্যাচার-পৈশাচিকতার পর কিছুদিন আমতা আমতা করে আবার চাষীদের জমি কেড়ে ক্ষেতমজুরদের জীবিকাহীন করে শিল্পায়নের পক্ষে সওয়াল করা হচ্ছে? আর সবার অলক্ষ্যে ঝিকিয়ে উঠছে নীরা-নিরু-টাটা যুগলবন্দীর ঠোটেঁর বাঁকা হাসি।
এই প্রক্রিয়ারই অঙ্গ হিসাবে যেখানে অধিগ্রহন এবং উচ্ছেদের প্রশ্ন নেই এবং রেলের নিজম্ব প্রকল্প হতে যাচ্ছে সেখানেও বাধা দেওয়া হচ্ছে, যাতে চাপের মুখে জবরদস্তি অধিগ্রহন করে বেসরাকরি হাতে জমি তুলে দেওয়ার সিপিএমের নীতিকে বাধা দেওয়ার রাস্তা থেকে তৃণমূল সরে আসতে বাধ্য হয়। শিল্পায়নের নামে টাটা-সালিমদের হাতে রাজ্যের জমি তুলে দেওয়ার জন্য রেলের হাত ধরে বাংলায় শিল্পায়নের মরা গাঙে নবজীবনদায়ী ম্রোতধারাটিকে প্রথমেই স্তব্ধ করে দেওয়াটাই পরিবর্তনের হাওয়া রুখে দেওয়ার পয়লা ষড়যন্ত্র। নির্বুদ্ধিতা, জেদ, অদূরদর্শিতা, দম্ভের কারনে সিপিএম নিজে যেটা পারিনি তা অন্য কাউকে করতে দেব না, তাতে রাজ্যের সর্বনাশ হয় হোক।
দ্বিতীয় ষড়যন্ত্রটি গত এক বছর ধরে সাফল্যের সঙ্গে কার্যকর করা হচ্ছে জঙ্গলমহলে। যৌথবাহিনীকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে হার্মাদ বাহিনীর সন্ত্রাসের সাহায্যে জঙ্গলমহলের মানুষের দীর্ঘদিনের বঞ্চনার প্রতিবাদে পরিবর্তনকামী ক্ষোভকে দমন করা হচ্ছে আসুরিক শক্তির সাহায্যে। মাওবাদি দমনের নামে বিরোধী নিকেশের এ-এক অপূর্ব কৌশল। যৌথ বাহিনীর নামে রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে পার্টি শক্তির এই নির্লজ্জ যৌথ ব্যাভিচার নরেন্দ্র মোদিকেও লজ্জায় ফেলে দেবে। অসংখ্য মানুষকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত রেখে ভোটব্যাংক হিসাবে ব্যবহারের পর যখন সেই বঞ্চিত গরিব মানুষের চেতনা ফিরছে তখন তাদের ওপর সন্ত্রাসের বুলডোজার চালিয়ে দেওয়ার স্তালিনীয় কৌশল নেওয়া হচ্ছে এই একবিংশ শতাব্দীতে। যে ভয়ে মুখ বন্ধ রাখবে না তার মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হবে। দেখে অবাক লাগে, এর পরেও এই পার্টির দৃ-কান কাটা সাধারন সম্পাদকটি সর্বহারার সর্বাধিনায়ক সেজে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাকতাল্লা মেরে আসেন।
তৃতীয় কৌশলটি নেওয়া হয়েছে গ্রাম বাংলায়। এটি প্রধানত রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে যেখানে পার্টি এখনও শক্তিশালী কিন্তু দ্রুত ক্ষয় আসন্ন সেখানে ভাঙ্গন সামাল দেওয়ার উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসের কৌশল। সম্ভবনা থাকলে কোথাও কোথাও হারানো জমি ফিরে পাওয়ার কৌশলও। পুলিশ হাতে, পার্টি মোটামুটি শক্তিশালী, জোতদার টাইপের বড় কৃষকেরা আর স্কুলশিক্ষক/পঞ্চায়েত/জেলাপরিষদ কর্মী-কাম-চাষী টাইপের চাকুরীজীবি পয়সা ওয়ালা শ্রেণী যেখানে পার্টির সঙ্গে আছে সেখানেই সন্ত্রাস ব্যবহার করা হচ্ছে পরিবর্তনকামী মানুষের মুখ বন্ধ করতে। যাঁরা বিরোধী মিছিলে পা মেলাচ্ছিলেন, ইতিউতি মিটিং-এ যাচ্ছিলেন তাঁরা আচমকা তলপেটে গুলি বোমা খাওয়ার বা ধানের মড়াইয়ে আগুন লাগার ভয়ে, ঘরে বসে থাকতে বাধ্য হবেন। দৃশ্যতঃ বিরোধী শক্তি ক্ষীয়মান হবে। প্রচার করা হবে পার্টি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
যারা এই ধরনের অপকৌশলের সাহায্যে যেনতেন প্রকারেণ রাজ্যে ক্ষমতাসীন হয়ে থাকতে চায় তাদের মাধ্যমে রাজ্যে প্রবন্ধের প্রথমে উল্লেখ করা কাঙ্খিত পরিবর্তনগুলি যে কখনোই আসতে পারে না তা রাজ্যের মানুষ এতদিনে বুঝে গেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই পরিবর্তন কী তৃণমূল বা বিরোধী জোটের পক্ষেও আনা সম্ভব?
প্রশ্নটা এই কারনেই উঠছে যে, রাজ্যের বিভিন্ন অংশে যে দুর্নীতিগ্রস্ত স্বার্থান্বেষী অংশ সিপিএমের সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা পরিবর্তনের হাওয়ায় সামিল হয়ে তারা ধীরে ধীরে বিরোধী শিবিরের ছত্রচ্ছায়া খুঁজছে। বেশ কিছু অভিযোগ শোনা যাচ্ছে তৃণমূল শাসিত পঞ্চায়েত, পৌরসভা এবং জেরা পরিষদ গুলির বিরুদ্ধে। এর একাংশও যদি সত্য হয় তাহলে অবশ্যই আশঙ্কার কথা। তার চেয়েও বড় কথা দৃর্নীতিগ্রস্ত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তৃণমূল ব্যবস্থা নিয়েছে এমন উদাহরণও সুলভ নয়। বরং হাবভাবখানা এমন, ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচন পার হোক, তারপর যা হোক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে এদের বিরুদ্ধে। কিন্তু ২০১১-র পর যখন কেন্দ্র-রাজ্য-পঞ্চায়েত-পৌরসভার নিশ্ছিদ্র নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে চলে আসবে তখন এই দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উৎসাহ আদৌ দলের থাকবে তো? সন্দেহটা চেপে ধরে যখন দেখি দলনেত্রী দুনীর্তিগ্রস্ত লোকেদের স্রোতে ভেসে আসা আবর্জনার সঙ্গে তুলনা করে সময়ে স্রোতে ভেসে যাওয়ার স্তোক দেন। সিপিএম তবু শুদ্ধিকরণের একটা কুনাট্য মঞ্চস্থ করার মাঝেমধ্যে চেষ্টা করে, ওঁর সে বালাইও নেই।
দুনীর্তির প্রশ্নে আরও একটা বড় আশঙ্কার জায়গা তৃণমূল কংগ্রেসের দোসর কংগ্রেস নামক আপাদমম্তক দুর্নীতিগ্রস্ত একটা পাটি। দেখে শুনে মনে হয় শুধুমাত্র মহাত্মা গান্ধীর নাম ভাঙ্গিয়ে দুর্নীতি করার জন্যই এই পার্টিটাতে লোকজন যোগ দেয়। মাঝেমধ্যে শিউরে উঠি, যখন দেখি আশু ক্ষমতার গন্ধে কীভাবে এদের লালা ঝড়ছে, দাঁতে নখে শান দিচ্ছে সিপিএমের থাবা থেকে দুনীর্তির মাংসখন্ড ছিনিয়ে নেওয়ার আশায়। “সম্মান” নয়, সংসদীয় গণতন্ত্রের এই পচাগলা দিকটার মাদকতাময় গন্ধই কংগ্রেসের জোটবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান উদ্দীপক এটা বোঝা আদৌ কঠিন নয়। আসলে যথাসম্ভব বড় টুকরোয় নখ বসানোর জন্যই যাবতীয় দরকষাকষি।
রাজ্যবাসীর আরও একটা বড় চিন্তার কারন, শুধুমাত্র ভোট বাক্সের কথা ভেবে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মৌলবাদিদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোষামোদ, যা ভবিষ্যতে রাজ্যে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। আমি জানি, তৃণমূল কংগ্রেসের ভিতরে এটা নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে, দলের অনেক নেতানেত্রীই এটা মেনে নিতে পারেন না। কিন্তু, আবারও ২০১১র নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবিসংবাদী নেতৃত্ব এবং ‘দূরদর্শিতা’র ওপর ভরসা করে কেউই প্রকাশ্যে এর বিরোধীতা করে উঠতে পারেন না। এমন নয় যে, সিপিএম সফট কম্যুনালিজমের এই নোংরা খেলাটা খেলে না। কিন্তু অত্যন্ত কৌশলী কায়দায় তারা সাম্প্রদায়িক খেলাটাকে প্রায়শঃই দৃষ্টিকটূ সীমার নীচে রাখতে সমর্থ হয়। কিন্তু ক্ষমতায় আসীন হওয়ার মত্ততায় মমতা সেই লাজলজ্জাটুকুর ধারও ধারছেন না।
২০১১ বিধান সভা নির্বাচনের পর তৃণমূল (বা তৃণ-কং জোট) ক্ষমতায় আসলে অন্য ইস্যুগুলোতে পরিবর্তন কতখানি আসবে তা নিয়ে কেউ কেউ কিঞ্চিত আশাবাদী হলেও, রাজ্যে নৈরাজ্য কমবে এমন আশা বোধহয় কেউই করেন না। কারন, বর্তমানে সিপিএম যে নৈরাজ্যে প্রশ্রয়ের অভিযোগ বিরোধীদের প্রতি করে, ক্ষমতায় না থাকলে সিপিএম নিজে এর থেকে বহুগুন নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পটু তা একটু বয়স্ক রাজ্যবাসীর অজানা নয়। ২০১১য় সিপিএমের বিধায়ক সংখ্যা খুব কমে গেলেও ৩০-৩৫ শতাংশ মানুষের সমর্থন তাদের দিকে থাকবে এটা মোটামুটি আন্দাজ করা যায়। আর এই মানুষদের একাংশকে প্ররোচিত করে এবং ক্যাডার/হার্মাদ বাহিনীকে দিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির একটা মরিয়া চেষ্টা সিপিএম করবে এটা একরকম নিশ্চিত। কাজেই নির্বাচন পরবর্তি পর্যায়ে রাজ্যে নৈরাজ্য মুক্তির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
সুতরাং, বাংলার রাজনীতিতে পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটা যে বেশ জটিল এবং নিছক রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতবদলের মাধ্যমে আসবে না এটা স্পষ্ট। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তান্তরটা এই মুহূর্তে আশু প্রয়োজন অন্য সব কিছুর থেকে। ২০১১-র রাজনৈতিক পালাবদলের মাধ্যমে বাংলার রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামাজিক পরিবেশের তাৎক্ষণিক আমূল পরিবর্তন হয়তো আসবে না ঠিকই, কিন্তু ক্রমাগত ক্ষমতার হাত বদলের প্রক্রিয়া দুর্নীতিগ্রস্তদের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা নিশ্চিন্ত মৌরসিপাট্টায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করলে সেটাও কম প্রাপ্তি নয়। প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ব্যর্থতা নির্বাচনে বাড়তি গুরুত্ব পেলে স্বাভাবিক ভাবেই ভোটব্যাংকের রাজনীতিও ধীরে ধীরে প্রাসঙ্গিকতা হারাতে শুরু করবে। পুলিশ-প্রশাসনকেও দলতন্ত্রের তাঁবেদার করে রাখা হয়তো আরও একটু কঠিন হয়ে পড়বে।
তাই ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে বাংলার ক্ষমতার হস্তান্তর যদি নিছক রাজনৈতিক পালাবদলও হয়, এই মুহূর্তে সেটাই সবথেকে জরুরী বাংলার মানুষের কাছে। তারপর বাংলার রাজনীতি সচেতন পরিবর্তনকামী মানুষের ক্রমাগত নজরদারি ও চাপ ভারতীয় গণতন্ত্রের কালিমাগুলি ধীরে ধীরে মুক্ত করে দিয়ে বাংলার আকাশে সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে পারবে এই আশা করা যেতেই পারে।