Wednesday, March 9, 2011

মাও - মমতা আঁতাত, - একটি চিরাচরিত বামপন্থী কুৎসা - সায়ন ঘোষ


মাও - মমতা আঁতাত, - একটি চিরাচরিত বামপন্থী কুৎসা
সায়ন ঘোষ

আপনারা নিশ্চয় সকলেই বিখ্যাত নাৎসী প্রচারসচিব যোসেফ গোয়েবেলস এর নাম শুনেছেন, ব্রিটিশদের প্রচার কায়দার সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়ে তিনি একটি বিখ্যাত উপায় বের করেছিলেন, - “একই মিথ্যা কে বারবার করে লোকের কানে প্রবেশ করাও, লোক তো দূরের কথা ভুতের বাপেও বিশ্বাস করবে সেটা সত্যি”। অবশ্য কেবলমাত্র ব্রিটিশদের একা দোষ দিয়ে লাভ নেই, গোয়েবেলসের আগেও লেনিন নামক এক নরঘাতক ও তার সুযোগ্য সঙ্গীরা মহান (?) অক্টোবর বিপ্লবের পটভূমিকায় ও তার পরে নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার মসনদে লড়াইহেতু গৃহযুদ্ধে এই কায়দা কে যথেস্ট সাফল্যের সঙ্গে ব্যাবহার করেছিলেন, তাই কেউ যদি এই একই কায়দাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে তারা হলেন কমিউনিস্টরা এবং ক্রমবিবর্তনের ফলে যে তাদের বঙ্গজ কমরেডরা সেটা আরো অনেক কিছুর মতন এটারো অন্ধ অনুকরন করার আপ্রান চেস্টা করে যাবেন এতে আর সন্দেহের অবকাশ থাকে বলে তো আমার মনে হয় না। সেই রকমই একটা ব্যার্থ প্রয়াস ‘মাও-মমতা আঁতাত’, বা বাংলার ‘জোয়ান অফ আর্কের’ নামে ‘মাওমাতা’ নামের শিরোপা প্রদান। বেশ বেশ তাতে কোন ক্ষতি নেই কারন ইতিহাস সাক্ষী আছে যারাই স্থবির সমাজব্যাবস্থায় ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ক্ষমতার একছত্র আধিপত্যে বুকে কুঠারাঘাত করে বিপ্লব এনেছেন তারাই এমন উপহাস আর শিরোপাতে ভূষিত হয়েছেন, ঠিক যেমন ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে আমেরিকাতে কেউ বৃহৎ কর্পোরেশানগুলির একচেটিয়া মুনাফা লাভের পথে অন্তরায় হয়ে দাড়ালে তাকে ‘কমিউনিস্ট’ আখ্যা দেওয়া হতো, আজো হেলথ কেয়ার সংক্রান্ত একটি যুগান্তকারী বিলে সই করায় আমেরিকান প্রেসিডেন্টকেও ‘কমিউনিস্ট,সোস্যালিস্ট’ অখ্যা দেওয়া হয়, ঠিক আজকে যেমন লিবিয়ায় গণতন্ত্রকামীদের তথা জনবিপ্লবের প্রতিনিধিদের নামে আল-কায়দার সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে তেমনই বিগত ৩৫ বছর ধরে মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির হাতে রিক্ত,ধর্ষিত,বঞ্চিত,শোষিত,অত্যাচারিত বাংলার বুকে, বাংলার মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক জণবিপ্লবের ঢেউ যিনি তুলেছেন তার নামেও যে একই কুৎসা রটানোর আরেকটি অন্ধ অপ্রয়াস হবে সেটা আর নতুন কি। তবে যে কোন ব্যাপারেই সিপিএমের বুদ্ধিটা যথেস্ট কাঁচা, এটা অবশ্য নতূন কোন তথ্য নয়, তবুও দেশের কথা ভাবার সময় হোক না হোক হনুলুলু থেকে হোক্কাইডো যারা বিপ্লবের জন্য থিসিস আওড়ান তারা এটা ভুলে গেছেন যে বাংলার মানুষ দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে যে লাল-সন্ত্রাসের সহজ শিকার হয়েছেন, সরকার ও সমাজব্যাবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে দলতন্ত্রের দাম্ভিকতা ও নিষ্ঠুর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতক্ষ্য করেছেন তাদের সামনে হাজার মিথ্যা লক্ষ বার বললেও তারা এক অচলায়তনের পতন ঘটাতে দৃঢ় প্রতিঞ্জ।

কিন্তু তবুও সেই মাও-মমতা যোগসাযোগের মত নগ্ন মিথ্যাগুলোর আসল স্বরূপ প্রকাশ করার মাধ্যমে সিপিএমের আসল চেহারাটা দেখা যাক, কারণ মুখে যারা নিজেদের গরীবদরদী, কৃষকদরদী বলে পরিচয় দিয়েছেন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের গণহত্যায় তাদের সেই মুখোশ খুলে গেছে, জঙ্গলমহলের হতদরিদ্র আদিবাসীদের উপর আর্মড ক্যাডার দিয়ে অত্যাচার করে নিরস্ত্র প্রতিরোধের যে মিথ্যা কাহিনী বলা হচ্ছিল নেতাই এর গণহত্যা রাজ্যের আম আদমির কাছে সত্য উদঘাটন করে দিয়েছে আরো এক কমিউনিস্ট ভাঁওতাবাজির। তাই মাও-মমতা গল্পটির আসল সত্য সকলের সামনে আসা দরকার বলে মনে করি।

এখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই একটা প্রশ্ন উঠতে পারে গত ২০০৯ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই যে মিথ্যা অপ্রচার চালানো হচ্ছিল এবং কেবলমাত্র লোকসভা নয়, বিধানসভা উপনির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচনেও মানুষ যে মিথ্যাকে বর্জন করেছে তার পরেও কেন এক নির্লজ্জ মিথ্যার বিরুদ্ধে লেখালেখি বা বিরোধিতা, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হয় নইলে শত যুক্তিগ্রাহ্য কারন দেখালেও উত্তর হয়ত অসমাপ্ত রয়ে যাবে। প্রসঙ্গত লিখে যখন ফেললাম তখন একটা ছবিও পাঠকরা দেখে নিতে পারেন ২০১০ এর কলকাতা পৌরসভা নির্বাচনের জন্য সিপিএম যে পোস্টার বানিয়েছিল ইন্টারনেট ঘেঁটে খুজে একটা পেলাম। আর তার প্রতিউত্তরে মানুষ কি জবাব দিয়েছেন সেটাও ছবির আকারেই তুলে দিলাম। এমন বৈপরীত্য চট করে দেখা যায় না।

কলকাতা পৌরসভা নির্বাচনে সিপিএমের পোস্টার 


কলকাতা পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল 

যাইহোক যে ঘটনার কথা বলছিলাম, গত ১৩ই ফেব্রুয়ারী ব্রিগেডে সিপিএমের জনসভা ছিল, দিনটি আমার মনে রাখার একটি বিশেষ কারন ছিল, না না গল্পের গরূ গাছ ছেড়ে মগডালে ওঠার মতো ১৭ লক্ষ্য কল্পনাপ্রসূত ভিড়ের গল্পের জন্য না; মনে ছিলে ওই দিন সর্বভারতীয় স্তরে গেট (GATE – Graduate Aptitude Test for Engineers) পরীক্ষা ছিল, আরো কয়েকটি এম.বি.এর পরীক্ষাও ছিল, ওইদিন আমার মত কত ছাত্রছাত্রীর যে পরীক্ষাহল থেকে বাড়ি ফিরতে ও দ্বিতীয় অর্ধে পরীক্ষা দিতে যেতে গিয়ে বিশাল ভোগান্তি আর হয়রানির শিকার গয়েছেন সে আর বলার নয়, তা সে প্রসঙ্গ থাক। সেইদিন হয়ত সকলের মনে থাকবে গ্রাম থেকে যে বিপুল জনসমস্টি কলকাতায় এসেছিলে চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া, কালীঘাটের মন্দির ইত্যাদি দর্শনীয় স্থানের সাথে আরেকটি স্থান ও দেখে যান সেটি হচ্ছে মমতা ব্যানার্জীর বাড়ি। তাদের কতজন যে খুব আগ্রহভরে বাড়িটি দেখে বিশ্ময় প্রকাশ করে বলেছেন যে – “ও মা, যা শুনেছিলাম তাই। এতবড় নেত্রী সত্যিই টালির বাড়িতে থাকে!না দেখলে মানাই যায় না’। - তা আর কহতব্য নয়। তাই ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম ধনী দল সিপিএম যখন জেলায় জেলায় কোটি টাকায় নির্মিত পার্টি অফিস তৈরী করে ‘সততার প্রতীক’ মমতা ব্যানার্জীর নামে টিপ্পনী কাটে এবং নিজেদের সমর্থকদের কাছে অঞ্জানতার মিথ্যা কুৎসা রটায় সেটা তবু মেনে নেওয়া যায় কিন্তু সিপিএমের সমর্থকদের ভুল ধারনাগুলো যখন আগের উল্লেখ করা ঘটনার মত ভেঙ্গে যায় তখন মনে হয় সমস্ত মিথ্যার জবাবে সত্যিটা তুলে ধরার বিশেষ প্রয়োজন আছে। তাই আশা করি এর পরেও যারা প্রশ্নের উত্তর খুজতে আরো আগ্রহী হবে তারা তাদের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন।  

ভারতবর্ষের একটি অন্যতম সম্পদ হচ্ছে তার গণতন্ত্র, তার যাবতীয় অক্ষমতা সত্তেও। ক্ষমতাসীন শাষকগোষ্ঠীর সীমাহীন লোভ, সরকারি কর্মকর্তাদের দরিদ্র আদিবাসীদের উপর অত্যাচার সিপিএমের মাসতুতো ভাই মাওবাদীদের বিচ্ছিন্নতামূলক রাজনীতিতে অক্সিজেন যোগাতে পারে তবে দরিদ্র আদিবাসীদের আবেগ ও বঞ্চনাকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে ক্ষমতার মসনদে আসার জন্য তারা যে পথ বেছে নিয়েছে এককথায় তা সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদের রাস্তা, তাদের সঙ্গে মমতা ব্যানার্জীর মতো জণনেত্রীর নাম জরানো মানে প্রকারন্তে মমতা ব্যানার্জীকে দেশদ্রোহী আখ্যায় ভূষিত করা, অবশ্য যারা দেশনায়ক সুভাষচন্দ্রকে “দেশদ্রোহী” ‘তোজোর কুকুর’ বলতে পারেন তারা একটু ঘুরিয়ে নাক দেখিয়ে মমতা ব্যানার্জীকেও বলবেন এতে পাঠকদের অবাক হবার কিছু নেই।  

পুলিশমন্ত্রীর অপদার্থ পুলিশ একটি গণহত্যাকারীকে হত্যার উদ্দেশ্যে ঘটানো নাশকতার ঘটনাকে আটকাতে না পেরে বাউল গানের অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে নাবালক ছাত্র সহ ৩ জনকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে আর তার জেরেই গরে ওঠে পিসিপিএ বা পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারনের কমিটি। মমতা ব্যানার্জীর দোষ এটাই যে তিনি  সম্পুর্ন স্বতঃফুর্ত ভাবে গড়ে ওঠা একটা আন্দোলন যার পুরোধা ছিলেন আদিবাসী রমনীরা সেটাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। ছত্রধর মাহাতো মাওবাদীদের সাহায্যকারী ছিল কিনা জানা যায় নি, তার গ্রেপ্তারের সময়ে ১ কোটি টাকার জীবনবিমার যে কথা পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মহানির্দেশক ভূপিন্দর সিং সংবাদমাধ্যম কে বলেছিলেন সেটাও আজো কোন সংবাদ পত্র দেখাতে পারে নি না পুলিশ দেখাতে পেরেছে। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া যায় যে একদা তৃণমূল থেকে বহিঃস্কৃত ছত্রধর মাহাতো মাওবাদীদের সাথে ছিলেন তাহলে একদা সিপিএম নেতা ও কর্মী লালমোহন টুডু কেন মাওবাদীদের দলে নাম লিখিয়ে ফেললেন কে জানে? একটি জনআন্দোলনকে পুলিশী বর্বরতা দিয়ে জোড় করে দমন করতে চাইলে যা হয় লালগড়েও তাই হয়েছে, মানুষ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পাতা ফাদে পা দিয়েছেন আর লোকসভা নির্বাচনের আগে জঙ্গলমহলের মতো শক্তিশালী দূর্গে নিজেদের ক্ষমতা হারানোর ভয়ে পিসিপিএ নেতা-কর্মীদের খুন করে এই ফাদ পাততে সবথেকে বেশী যদি মাওবাদীদের সাহায্য করে থাকে তারা হল সিপিএম।
২৪ শে এপ্রিল, কলকাতায় পিসিপিএ এর সভা ও মিছিল 

এবার আসি সেই বিখ্যাত ছবির কথায় যে ছবি দেখিয়ে বারবার প্রচার করা হয় মাওবাদীদের সাথে মমতার কাল্পনিক জোগাজোগের কথার, নিচের ছবিটি তোলা হয়েছিল ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ২০০৯। বলা বাহুল্য ২৩ শে মার্চ ২০০৯ এ পিসিপিএ যে ভোট বয়কটের ডাক দেয় তার জন্য এর পশ্চিম মেদেনীপুরের জেলাশাষক নারায়ন নিগম ও এস.পি মনোজ ভার্মার সাথে ছত্রধর মাহাতো ও লালমোহন টুডুর বৈঠক হয় ২৫ শে মার্চ ২০০৯, এর পরে ৩০শে এপ্রিল ২০০৯ এ লালগড়ে রাজ্যের নির্বাচনী অফিসার দেবাশিষ সেনের সাথে ছত্রধর মাহাতোর সাথে বৈঠকে পিসিপিএ এর শর্তাবলী নির্বাচন কমিশন মেনে নিলে ভোট বয়কট ইয়ঠে যায়।  পাঠকদের নিশ্চয় মনে আছে কলকাতা পুলিশ ও রাজ্য সরকারের অনুমতি নিয়ে খোদ কলকাতার বুকে পিসিপিএ একটি সভা ও মিছিল করে ২৪ শে এপ্রিল ২০০৯। লোকসভা ভোটের ফলাফল বেরোয় মে মাসে, তাহলে কি দেখা যাচ্ছে যে মমতা ব্যানার্জী ফেব্রুয়ারী মাসে একটিমাত্র সভায় উপস্থিত হয়ে মাওবাদীদের অংশীদার হয়ে গেলেন আর অন্তত ডজন খানেক সরকারি আধিকারিক, কলকাতা পুলিশের কমিশনার, মহাকরনের সেক্রেটেরিয়েটের অফিসারেরা যারা সিপিএম পরিচালিত রাজ্য সরকারের কর্তাব্যাক্তি ও নির্বাচন কমিশন,, তারা একাধিক বার পিসিপিএ এর নেতাদের সাথে বৈঠক করে, তাদের মিছিলের অনুমতি দিয়েও মাওবাদী হলেন না। বেশ মজার ব্যাপার কিন্তু যাই বলেন।
      
৪ ঠা ফেব্রুয়ারী ২০০৯, পীড়াকাটায় মমতা ব্যানার্জী 
আরো মজার ব্যাপার আজকের দিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ইউ.এ.পি.এ আইনে মাওবাদীরা নিষিদ্ধ হলেও, পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীরা বা তাদের তথাকথিত ফ্রন্টাল অর্গানাইজেশান পিসিপিএ নিষিদ্ধ নয়। এতএব ২০১০ এ মমতা ব্যানার্জীর লালগড়ের সভায় যদি পিসিপিএর সমর্থনকারীরা আসেন তাহলে ক্ষতি কি? প্রথমত পিসিপিএ কোন নিষিদ্ধ সংগঠন না, আর না তার সমর্থকেরা পিসিপিএ এর পতাকা নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের সভায় যোগ দিয়েছিল। আর যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে "পিসিপিএ মাওবাদীদের ফ্রন্টাল অর্গানাইযেশান" তাহলেও ত সেখানে মমতা ব্যানার্জীর ভূয়সী প্রশংসা করতে হয় কারন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পাতা ফাদকে উপেক্ষা করে এক বিশাল সংখ্যক মানুষের মধ্যে তিনি আবার গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন। 


আরো একটি দাবী তোলা হয় কোটেশ্বার রাও ওরফে কিষেনজীর একটি দাবী নিয়ে যে তিনি মমতাকে এই রাজ্যের ভাবী প্রশাষক হিষাবে দেখতে চান, এতে যদি মাওবাদী যোগাযোগ পরিস্কার হয়ে যায় তাহলে কোন সুস্থ মানুষের বুদ্ধি নিয়ে একটা প্রশ্নচিহ্ন উঠে যায়। বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি সিপিএম নিয়েও অনেক কথা বলেছে তাদের এই কথাটা মেনে নিলে এটাও মেনে নিতে হয় যে তারা সিপিএম সম্পর্কে যা যা বলেছেন সেগুলো সত্যি। আবার এই রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সিপিএম্র প্রচারের বিরুদ্ধে গিয়ে টিএমসি ও মমতা ব্যানার্জীকে ভোট দিয়েছেন, এই রাজ্যের এত মানুষ (লোকসভা নির্বাচনের হিষাব ধরলে সংখাটা ২-২.৫ কোটির মতো) মাওবাদী প্রভাবিত আমার জানা ছিল না। অবশ্য যারা পার্লামেন্টে পরাজিত হয়ে ‘মানুষ বিষ পান করেছেন, টাকা খেয়েছেন’ বলতে পারেন তারা যে প্রকারন্তরে এই রাজ্যবাসীকে মাওবাদী আখ্যা দেবেন এ আর নতূন চমক নয়, পাঠকেরা কি বলেন? মাওবাদীরা রেলমন্ত্রীর আর ভারতের গরিব মানুষের বন্ধু হলে বিভিন্ন সময়ে গরিব মানুষের যোগাযোগের একমাত্র উপায়, দেশের লাইফ লাইন রেলের উপর না হামলা হত না মাওহানার কারনে প্রতি বছর রেলের ১৫০০ কোটি টাকা ক্ষতি হত। আরো একটা কথা নেতাই এর ঘটনা থেকে দিনের আলোর মতো আজ স্পস্ট কেন মমতা ব্যানার্জী বারবার জঙ্গলমহল থেকে যৌথবাহিনী সরানোর দাবী তুলেছিলেন, এই নিয়ে বিস্তারিত ভাবে আগেও “নতূন সুর্য্যদ্বয়ের উপাখ্যানঃ জঙ্গলমহল” নামে বিস্তারীত লিখেছি তাই আর লিখছি না।           

এর পরে আরেকটি ঘটনার কথা বলা যাক, যে সভায় মমতা মাওবাদী মুখপত্র আজাদের এনকাউন্টারে হত্যার দাবী তুলেছিলেন, এমন বলছি না মাও মুখপত্র আজাদ সাধুপুরূষ ছিলেন, কিন্তু ভারতীয় সংবিধান বিরলতম অপরাধে দোষীকেও সাম্য ও ন্যায়ের বিচার দেয়। সেদিক দিয়ে ভারতীয় সংবিধান ও আইনের মাপকাঠিতে এই দাবী অনায্য, অগণতান্ত্রিক বা অসাংবিধানিক নয়।শেষ করব একটি ঘটনার কথা বলে কদিন আগে রাজারহাটে তৃণমূল কংগ্রেসের জনসভায় নেত্রীর মোটর বাইক আরোহিত একটি ছবি সিপিএমের মুখপত্র গণশক্তি প্রকাশ করে বলে ছত্রধর মাহাতোর স্কুটারে চেপে নেত্রী যাচ্ছেন, আস্ত বাইক কে স্কুটার বলতে একমাত্র গণশক্তিই পারে, কিন্তু রাজারহাটের দলীয় নেতা তারক ভট্টাচার্য্যকে ছত্রধর মাহাতো ঠিক কি ভাবে বানানো গেল কে জানে। কলিকালে অনেক কিছুই নাকি হয়, এতো আবার ঘোর কলি। ইয়ালো জার্নালিজমের পরাকাষ্ঠা গণশক্তি (পার্টি মুখপত্র বলতে সিপিএম বাবুদের ঠিক কেমন গায়ে লাগে) আইনি নোটিশে নিঃসার্থ ভাবে ক্ষমা চায় মমতা ব্যানার্জীর কাছে, এর থেকে বড় প্রমান আর কি হতে পারে যে গল্পের গরু কে গাছে উঠিয়ে দেবার মত মাও-মমতা যোগাযোগের কুৎসা রটাতে সিপিএম কতটা অপারগ।



যাইহোক এবার একটা প্রশ্ন আছে, অনেক সিপিএম কর্মী সমর্থককে করেছি, ইউটোপিয়ান উত্তর পেয়েছি তবু কন্সট্রাকটিভ কোন উত্তর পাইনি। এই রাজ্যের সি.আই.ডি তেলেগু দীপক, কাঞ্চন, প্রসূন চট্টোপাধ্যায়, রাজা সরখেল সহ অনেক বড় মাপের মাওবাদী নেতাকে ধরে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করেছে তারা কেন মাও-মমতা জোগাজোগের কথা সরকার কে দিচ্ছে না? কেনই বা তারা তা মিডিয়ার সামনে আনছে না, এখনো রাজ্যের ক্ষমতার মসনদে সিপিএম তারাই বা কেন পুলিশের কাছ থেকে প্রমান নিয়ে হাইকোর্টে মমতার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার মামলা করছে না কেনই বা জনগনের সামনে সরকারি স্তরে মাওমাতার মুখোশ খুলে দিচ্ছে না? শুধু পার্টির প্রচারেই এই মিথ্যা শোনা যাচ্ছে কেন? ক্যাডার পুলিশও কি শেষে সাইড চেঞ্জ করে ফেলল নাকি কে জানে? ওই যে বললাম ঘোর কলি। আসলে কোন প্রমানই ত নেই ত দেবে কোথা থেকে।

তাই স্পস্ট বোঝা যাচ্ছে এ আসলে এক সুপরিকল্পিত কুৎসা। এর জবাব মানুষ ই দেবে তবে ব্যালটে, একদলীয় পার্টিতন্ত্রে বিশ্বাসীদের  ক্ষমতালোভী  বর্বরদের তাদের প্রিয় ‘শুয়োরের খোয়ার’ থেকে নির্বাসনে যাবার সময় এসে গেছে তাই সিপিএম নামক পিপিলীকার পাখা গজিয়ে গেছে। ১৯৮৯ এ বার্লিনে দেওয়াল ভেঙ্গে যাবার দুবছরের মধ্যেই ১৯৯১ এ কমিউনিসমের মহীরূহের পতন ঘটেছিল। ২০০৯ এ দেওয়াল ভেঙ্গেছে এবার ২০১১।   

Saturday, February 5, 2011

মিশরের গণ অভ্যুত্থান ২০১১ঃ দিনলিপি - শুভ্রঙ্কর পাল





মিশরের গণ অভ্যুত্থান  ২০১১  দিনলিপি - শুভ্রঙ্কর পাল, (মিশর থেকে)

(১)


তিউনিসিয়ার গণঅভ্যুত্থান প্রেরণা জাগাল  মিশরীয়দের, সুয়েজ এর  পথ দখল করল আম জনতা । সেটা জানুয়ারি, ২৬ তারিখের ঘটনা। তার আগে ২৫ তারিখ কায়রোতে একটা জমায়েত হয়ে গেছে বটে, সে খবর আমায় দিয়েছেন, আমার এক বান্ধবী, খুব একটা পাত্তা-দিইনি সেটাতে; ব্যস্ত ছিলাম পেশা নিয়ে। অফিসেও স্থানীয় লোকজনকে এ বিষয় আলোচনা করতে শুনিনি, কিন্তু ২৬ তারিখের ঘটনা মোড় ঘোরাল। শুরু হল পুলিশী অত্যাচার। পুলিশ এ ভরসা না রেখে, পথে নামল দাঙ্গা পুলিশ, প্যাদিয়ে লাল করল জনতাকে। প্রতিবাদ ছড়াল মিশরের অন্যত্র। উত্তরের শহর  আলেক্সেন্দ্রিয়া, পথে  নামল মানুষ, দাবী একটাই, পরিবর্তন চাই, গদি ছাড়ো মুবারক, ত্রিশ বছর ক্ষমতা দখল করে দেশবাসী কে দিয়েছ দারিদ্র, আর কিছু ব্যক্তি মাত্র জমা করেছে বিপুল সম্পদ, সবত্র আর্থিক দুর্নীতি। অতএব, ছাড়ো গদি।



২৭ তারিখও মিসরের সব বড়ো সহরেই মানুষ শামিল হল প্রতিবাদে।

জুম্মাবার, ২৮ তারিখ, জানুয়ারি ২০১১, সাপ্তাহিক প্রার্থনার পর থেকেই মানুষ রাস্তায়, স্লোগান: ‘আল্লাহ-হো-আকবর’, ‘গদি ছাড় মুবারাক’। আলেক্সেন্দ্রিয়া, সুয়েজ-ই শুধু নয়, এবার প্রতিবাদ রাজধানী খাস কায়রোতেও। সমগ্র ডাউন-টাউন ভরে গেছে প্রতিবাদী মানুষে। প্রতিবাদ রুখতে দাঙ্গা পুলিশ লাঠি চালাচ্ছে, গুলি ছুড়ছে, রেয়াত করছে না কাউকে, নারী পুরুষ- শিশু কাউকে না। রাস্তায়, নেমেছে নারী, পুরুষ এমন কি শিশুও,কিশোর-কিশোরীও, বাবা মায়ের হাত ধরে তারাও নেমেছে প্রতিবাদে। অকুতোভয় মিশরের সব বড় সহরে একই ছবি। সরকারপক্ষও আগেই বুঝেছে, প্রতিবাদের ব্যাপ্তি,  তাই, ২৮ তারিখ সকাল থেকেই, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, স্তব্ধ, “সোশ্যাল মিডিয়ারকন্ঠ রোধের আয়োজন সম্পূর্ণ। আছে দাঙ্গা পুলিশও, কিন্তু প্রতিবাদী মানুষ কে রোখে কার সাধ্যি-ইতিহাস উল্টো কথা বলে যে। যখনি রাজা অত্যাচারী হয়েছে, পাত্তা দেয়নি প্রজা স্বাচ্ছন্দ্যকে,মানুষ দড়ি ধরে টান মেরেছে। সেই দড়ির টানে কটা মূর্তি ভেঙ্গেছে সেটা অন্য বিষয় কারণ টানের জোর ও স্থিতিজাড্ড্যর আলোচনায় আর এখন গেলাম না।

মানুষ ক্ষিপ্ত, দাঙ্গা পুলিশ এর উপর।দাঙ্গা পুলিশের ডাণ্ডা শুধু প্রতিবাদী মানুষের ওপরেই নয়, আক্রমণ করা হল, সাংবাদিকদেরও। আহত হলেন, সি.এন.এন, বি.বি.সি র সাংবাদিক ও তাদের সহযোগীরা। কায়রো তে প্রতিবাদের কেন্দ্রস্থল তাহ্রির স্কোয়ার, এখানকার ধর্মতলা, জমজমাট বিকিকিনি অন্যান্য দিন। আজ তার চেহারা আলাদা, কাতারে কাতারে প্রতিবাদী জনতা, পিছনের পরিচিত ৬ই অক্টোবর ব্রিজ ভড়ে গেছে মানুষে, নীল নদ পেরিয়ে অগুনতি মানুষ আসছেন প্রতিবাদে সামিল হতে। পুলিশের পক্ষ থেকে ক্রমাগত বিষাক্ত কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া হচ্ছে, সেসব উপেক্ষা করে, সাহসী প্রতিবাদী সামিল হচ্ছেন প্রতিবাদে। জায়গায় জায়গায় চলছে জনতা পুলিশ খণ্ড যুদ্ধ।



আগুন লাগান হল, সরকারী দলের সদর দপ্তর-এ। প্রতিবাদী জনতার উচ্ছ্বাস আর লেলিহান শিখাতে গা গরম করা শীতের সন্ধ্যে। সন্ধ্যে ৭ টা জারী হল কার্ফু, প্রথমে, কায়রোতে তারপর সমগ্র দেশে। কিন্তু রোখা গেল না মানুষকে। প্রতিবাদ চলছে রাজপথে, সন্ধ্যা শেষ রাত্রি ঘনাচ্ছে সেদিকে হুঁশ নেই কারও। মুবারাক জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন সন্ধ্যে সাড়ে সাত টায়, ঘোষণা করা হল, কিন্তু, কথা রাখলেন না তিনি। বার্তা এলো জগত বিধাতা মার্কিন মুলুক থেকে, ক্লিনটন সাহেবার বয়ানে, শ্যাম ও কুল দুই-ই রক্ষার চেষ্টা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিশর শুধু আমেরিকার জোটসঙ্গী-ই নই, দুই দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা আছে, মিশরের সুয়েজ খালের। কাজেই আমেরিকার মাথা ব্যথার কারণ যথেষ্ট।

কায়রোর রাজপথে নামল সেনা, সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক। মানুষ ভয় পেলনা, তথ্য সম্প্রচার এর সরকারী দপ্তর এর অভিমুখে চলেছে তারা, সেনা বাহিনী সামনে, অকুতোভয় প্রতিবাদী জনতা । সেনা বাহিনী সংহত আচরণ দেখাল, সম্ভ্রম পেল, প্রতিবাদী জনতার।জনতা কুরনিশ করল সেনাকে। এখানে সেনা বিশেষ স্থান অধিকার করে মিশরীয় জনতার দিল-এ।
সত্য বিচিত্র এ জগত। সেনা প্রধান প্রেসিডেন্ট স্বয়ং। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ আর তার সেনানীরাই পেল, জনতার কুনিশ। সহজ সত্য, অনেক সময়-ই, ঢাকা থাকে, নানান সরল বিশ্বাসে। যুক্তিতে বিশ্বাস রাখা পাপ, অনেকের কাছে; তার থেকে সহজ, বিশ্বাস রাখা; মাথায় চাপ কম পরে।

এদিকে পুলিশের সাথে আম জনতার খণ্ড যুদ্ধ চলছেই। জনতার হাতে, ইট পাটকেল, পুলিশ ছুড়ছে, গুলি, কাঁদানে গ্যাস, জল কামান। আহত বহু, রক্তাক্ত রাজপথ, তবু চলছে, প্রতিবাদ।হতাহতের সংখ্যা এখনো জানা যায়নি। মুবারাক গেলে, কে আসবেন তার কোন নিশ্চিন্তই নেই, প্রতিবাদ এর কোন নেতা নেত্রী নেই। স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থান। নেতা নেত্রী না থাকার কারণটা সংগত, ত্রিশ বছরের, জামানায়, কার্যত বিরোধী পক্ষ বলে কিছু নেই। আণুবীক্ষণিক বিরোধী মুসলিম ভ্রাতৃকুল শেষ মূহুর্তেপ্রতিবাদ এ সামিল হয়েছে বটে, তবে আন্দোলনের রাশ তাদের হাতে নেই।  কে নেবে দায়িত্ব ভার কোনও ইঙ্গিত মিলছে না, এদিকে সরকার পক্ষ থেকেও কোন বিবৃতি জারি হয়নি।

২৮ তারিখ, রাত ১০ টা, অন্যান্য দিন, এসময় অধিকাংশ মিশর ঘুমিয়ে পরে। কায়রো আজ নিদ্রাহীন, কতৃপক্ষ-হীন। প্রতিবাদের ভাষা আছে, প্রতিবাদীদের নেতা নেই, সরকারপক্ষ ও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, পুলিশ রাস্তা থেকে চলে গেছে, দোদুল্যমান অবস্থা। মানব বন্ধন হয়েছে বিখ্যাত মিশর সংগ্রহশালার সামনে। অভূতপূর্ব অবস্থা, প্রতিবাদী আছে, আক্রোশ নেই, কার বিরুদ্ধে জানাবে আক্রোশ, কোন সরকারী প্রতিনিধি নেই, পুলিশও হাল ছেড়েছে, সেনানীরা মিশে গেছেন জনতার ভিড়ে, জাতীয় পতাকা উড়িয়ে রাত ১১ টায়, পাশাপাশি চলেছে, আম জনতা ও সেনা বাহিনী। যাকে নিয়ে এতো কাণ্ড সেই মুবারাক কোথায়, কেউ জানে না,...



অতঃপর......
ধাক্কা তো পড়েছে, গণেশ উল্টোবে কি?

পশ্চিমবঙ্গ কি বলে? ত্রিশেরও বেশী সময়, ক্ষমতা কুক্ষিগত সেখানে।
মধ্যরাত ,তারিখ হিসেবে, ২৯ জানুয়ারি, রাস্তা, প্রতিবাদীদের দখলে, বাধা দেওয়ারও কেউ নেই, এই মাহেন্দ্র ক্ষণে এলো মুবারাক বাতা। জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রেসিডেন্ট, নতুন সরকার গঠনের (মন্ত্রীসভার রদবদল আদতে) প্রতিশ্রুতি দিলেন এবং ঝঞ্ঝাট বরদাস্ত করা হবে না সাফ জানালেন।মিশরের বিভিন্ন সমস্যাগুলি নিয়ে তিনি কাজ করে যাবেন, সে কথাও জানিয়ে দিলেন। মাঞ্জাটা কড়া, সন্দেহ নেই, হাতে সুতো রেখেই ছেড়েছেন, সেটাও বোঝা গেল।
তুলনা টানাটা বাড়াবাড়ি, তবুও; উল্লেখ্য বুদ্ধবাবু এতটা সাহসী হতে পারেননি, শিরে যখন সংক্রান্তি। এতয়েব, টান-পোড়েনটা রয়েই গেল, আগামী ভোর, কাকে কি বারতা পাঠাবে, কাল-ই জানা যাবে। এখনো মোবাইল চালু হয়নি, ইন্টারনেট সংযোগ ফিরে আসেনি, যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোয় নয়। এ লেখা কবে বাঙ্গালী পাঠক পড়বেন জানি না। TV চলছে অবশ্য তাতে লেখা পড়ান চাপের। সংস্কৃতের সেই শব্দটাই, এক্ষেত্রে লাগসই, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, হ্যাঁ, তাই অবস্থা, এখন প্রতিবাদীদের। কি আশা ছিল আর কি পেলেন তারা, তিউনিসিয়া ঘটল না, কারণ, এখন আপনি মিশরে আছেন, ভুলে যাবেন না জনাব।

দেখার বিষয়, এর পর কি ঘটে......কে মাথা নত করে।
শরচন্দ্র পথের দাবীতে দ্রুত ও আমূল পরিবর্তন কে বিপ্লব আখ্যা, দিয়েছেন; এই গণ অভ্যুত্থান (Up-rise) বিপ্লব (Revolution) ঘটায় কিনা, সেটা দশক আসনে বসে দেখার ইচ্ছে রইল, সময়ের দাবীর কাছে।
রাত দেড়টা, রাস্তায় এখনও প্রতিবাদীরা, বিশেষত: তরুণ তরুণী। এ ছবি, কায়রোর, এ ছবি আলেক্সেন্দ্রিয়ার। এই ক্ষণে মার্কিন মুলুক থেকে বাতা দিলেন স্বয়ং ওবামা সাহেব, শ্যাম ও কূল রেখে, মুবারাক বাতা তে, শিলমোহর লাগালেন।
অতএব, নটে গাছ ও ছোট গল্পের গপ্পো।





(২)

২৯ তারিখ, মানুষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, প্রতিবাদ চলছেই, বরং ছড়িয়েছে, দেশের অন্যত্র, যেমন লাক্সোর, আসোয়ান, এই সব অঞ্চলে। মোবাইল ফোন চালু হয়েছে, বটে, কিন্তু ইন্টারনেট সংযোগ নেই এখনও। রাজপথ এখন প্রতিবাদী ও সেনাবাহিনীর দখলে। পুলিশ নেই।কিন্তু জায়গায় জায়গায় খণ্ড যুদ্ধ চলছেই। রাস্তায় পুলিশ নেই, তবু ক্ষণে ক্ষণেই, গুলির আওয়াজ পাচ্ছি, কারা গুলি চালাচ্ছে?? এখানকার নিয়ম কানুন অনুসারে, আম জনতা, বন্দুক রাখতে পারেন না।অবস্থা সঙ্গিন হচ্ছে।

এনিয়ে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না, দেশের মানুষ প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট তা মানতে নারাজ। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে, অনিশ্চিত হচ্ছে; বন্ধ গলির মতো লাগছে, বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী।
বিকেল ৪ টে আবার জারী হল কার্ফু। হুমকি দেওয়া হল, সেনা বাহিনীর পক্ষ থেকে, কার্ফু না মানলে, ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে। প্রতিবাদী জনতা ফুঁৎকারে উড়াল, সে ধমকি। মুবারক বসে নেই, তিনি কথা রাখলেন, আগের রাতের প্রতিশ্রুতি মত, মন্ত্রীসভা বরখাস্ত করলেন। নিয়োগ করলেন, নতুন, ভাইস-প্রেসিডেন্ট, ওমর সুলেমান, প্রাক্তন, সেনা-গোয়েন্দা প্রধান। নতুন প্রধানমন্ত্রীও এলেন, প্রাক্তন, বায়ু-সেনা প্রধান।যা দাঁড়াল, সেনা বাহিনীকে নিজের পক্ষে নিয়ে, জনতার ওপর কায়েম হওয়ার চেষ্টা।

এদিকে, খবর এলো প্রতিবাদী জনতা, Ministry of Interior দখল করার চেষ্টা করেছে, সেখানে খণ্ড যুদ্ধে, বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কতো মানুষ হতাহত, জানা যাচ্ছেনা। যাবে কি করে, ব্যবস্থা, কার্যত ভেঙ্গে পরেছে, কেন্দ্রটা টিকে আছে মাত্র। এদিকে, মওকা বুঝে লুট-পাট শুরু হয়েছে, কারা করছে, সঠিক বোঝা যাচ্ছেনা।প্রতিবাদী মানুষ নিশ্চয় নয়।
খবর এলো, জেল ভেঙ্গে কুখ্যাত বন্দীরা পালিয়েছে।পুলিশের লেশ মাত্র কোথাও নেই। বন্দী পালান স্বাভাবিক। কারুর কারুর মতে, এসব হয়েছে ওপরতলার নির্দেশে, ঠিক যেভাবে, সাদ্দাম জামানায়, সাদ্দাম, বন্দিদের মুক্তি দিয়ে, অরাজকতা তৈরি করেছিলেন। অরাজকতা দিয়ে, বিদ্রোহ সামাল দেওয়ার কৌশল।



শোনা গেল, তরবারি হাতে, কিছু বাইক বাহিনী দেখা গেছে, কারুর কারুর হাতে বন্দুকও আছে। এরা কারা?
মহল্লায় মহল্লায় মানুষ নিজেদের পাহারাদার বাহিনী তৈরি করল, লাঠি, চেয়ার টেবিলের পায়া, ঘরোয়া চাকু, ইত্যাদি নিয়ে মানুষ রাস্তায় নামল। পালা করে ঘুম, পালা করে পাহারা দেওয়ার পালা।
রাত ঘনাচ্ছে, গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে এখনও।

৩০ তারিখ, সকালবেলা, জানা গেল মুবারাক, সেনা-দপ্তরে, বৈঠক করছেন, ওমর সুলতান সঙ্গী। এদিকে বেলা বারার সঙ্গে সঙ্গে মানুষও বাড়ছে, তাহ্রির স্কোয়ারে, এটাই এখন প্রতিবাদের কেন্দ্রস্থল, হবে নাইবা কেন তাহ্রির মানেই ত, liberation যদিও দেশের অন্যত্র ও চলছে প্রতিবাদ, কোথাও কোথাও হিংসাত্ত্বক, কোথাও বা শান্তিপূর্ণ
সারাদিন-ই গুলির শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। রসদের সন্ধানে বেরিয়েছিলাম, দোকান-পাট, সব বন্ধ,দু-একটি, যাওবা খোলা আছে, তাতে লম্বা লাইন, দোকান প্রায় খালি। যে অঞ্চলে থাকি, সেটার নাম মাডী, মুলতঃ আমার মত ভিন দেশীদেরই আখরা।জিনিস পত্রের চড়া দাম নিচ্ছে, আজ, মওকা বুঝে। স্থানীয় মানুষ, লাঠি হাতে, পাহারাদারের দায়িত্ব সামলাচ্ছে।আর আমার মত বিদেশীরা খাবার সংগ্রহে ইতি উতি উকি মারছেন। এদিকে তাহ্রির স্কোয়ারে প্রতিবাদে মুখর জনতা।


কারা এই জনতা??
সমাজের সব স্তরের মানুষ-ই আছেন তাতে, কিন্তু খুব বেশী করে চোখে পরছে, মধ্যবিত্ত মানুষ, যারা, আপিস করেন, দোকান পাট চালান; যারা ঘর-সংসারের দায়িত্ব নেন, সন্তান মানুষকরেন, তারাও আছেন। আর আছে অগুনতি ছাত্র-ছাত্রী, তারা তাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য লড়ছেন, সেটাই, তাদের বক্তব্য, কাড়ন এখানে, শিক্ষিত বেকার প্রচুর।দীন-দরিদ্র ও আছেন, তবে তারা সংখ্যায় কম; হয়ত তারা নিজেদের সমাজের বাহুল্ল্য মনে করেন।তাদের পক্ষে সেটা মনে করা স্বাভাবিক, শিক্ষার আলো, এখানকার সমাজে খুব বেশিদূর প্রবেশ করেনি, সচেতনতা আসেনি।দোহাই দেওয়ার জন্য কপাল তআছেই। অথ্যা, মুলতঃ মধ্যবিত্ত শ্রেণীই এই বিদ্রোহ-র চালিকাশক্তি। তারা অখুশি, গণতন্ত্র না থাকায়, তারা অখুশি স্নাতক হওয়ার পরও চাকরী না পাওয়ায়। তারা অখুশি, চাকরী পেয়েও কম মাইনে পাওয়ায়, যা তাদের, বৈভব কেনার সামর্থ্যযোগায় না, অথচ, এই দেশের-ই কিছু ব্যক্তি তা পারে।তারা বিরক্ত, সরকারে আর্থিক দুর্নীতি থাকায়। তারা বিরক্ত পুলিশী জুলুমের ওপর।তারা বিরক্ত হয়ে পরেছে, একই মুখ, দেশের প্রধান হিসেবে দেখতে দেখতে, প্রবল একঘেয়েমি, জ্বালিয়ে তুলেছে, এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে। এইসব পুঞ্জিভূত ক্ষোভ বেড়িয়ে এসেছে এতো দিনে।এরা Facebook করেন, Tweeter করেন; এরা প্রতিবাদও করেন; Facebook এর আলোচনাকে রাস্তায় বাস্তব করেছেন এরা। এরা নিজেদের দেশ নিজেরা চালাতে চান, নিজেদের পছন্দের লোককে নিজেরা নেতা বেছে নিতে চান।
বিকেল ৪ টে, আকাশে, যুদ্ধ বিমান (F16), মিলিটারি হেলিকপ্টার উড়তে দেখা গেল।তবে কি কাচির দুই ফলা ব্যবহার করছেন মুবারক, বিদ্রোহ দমনে? একলা, পুলিশ না থাকার ফলে অরাজকতা সৃষ্টি, জেল ভাঙ্গা, অপরাধীদের দৌরাত্ম্য, মধ্যবিত্ত শ্রেণী কে ভীত করে তোলা, অপর ফলা,স্থল ও বায়ু-সেনা বাহিনীর পেশীশক্তি দেখান।প্রতিবাদী জনতা হুমকিতে ডরালেন না।তাহ্রির স্কোয়ারে জনতার সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবেনা।



আসরে এলেন, আল্বেরাদাই, ইনি নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত, আমেরিকার সাথে ভাল সমর্পকআছে, বিরোধী চরিত্র। দেশে ছিলেন না বিদ্রোহ শুরুর সময়, ফেরার পর-ই তাকে গৃহবন্দী করা হয় বলে খবরে প্রকাশ।যদিও তার বক্তব্য, পাওয়া যাচ্ছিল, কোন জাদুবলে, জানিনা।তিনি এলেন তাহ্রির স্কোয়ারে, সন্ধ্যে ৭ তা, বক্তৃতা দিলেন, মানুষ জয়ী হবে, আশা প্রকাশ করলেন, মার্কিন সরকারকে পাশে দাড়াতে বললেন। ৮ তা নাগাদ, চলে গেলেন।

এতে, একটা, সুবিধে হল, প্রতিবাদীদের পক্ষে, এক বিশিষ্ট-জনকে পাওয়া গেল অন্তত; এতক্ষণ যাবদ, প্রতিবাদীদের পক্ষে কোনও মুখ ছিলনা, ছিল, জনতা।

সুবিধে বললাম, কাড়ন ওরকম-ই, সংবাদ মাধ্যম বললও।কার সুবিধা, সেটা পরে দেখা যাবে।
এদিকে কার্ফু উপেক্ষা করে প্রতিবাদ চলছেই।
অবস্থা এখনো কাহিল।
রা
ত হল।গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে এখনও। শুনলাম, পুলিশ স্টেশন, খালি থাকার দৌলতে, বহু লোকের হাতেই অস্ত্র চলে এসেছে।অস্ত্র যদি দুপক্ষের কাছেই থাকে, যুদ্ধ বাধার কারণ তৈরি হয় বৈকি। অবশেষে, জানা গেল, রাতে,পুলিশ ফিরেছে পথে, ৪৮ ঘণ্টা পরে, ততক্ষণে অবশ্য, বহু, দোকান পাট, লুট হয়ে গেছে; বহু লোকের হাতেই অস্ত্র পৌঁছে গেছে।
অরাজকতা বহাল; একটা ফল্গু মত, ভাসছে, এর থেকে বাচাতে পারেন একমাত্র, মুবারাক।গণতন্ত্র পরে, নিরাপত্তা আগে। তাইতো, কাচির একটা ফলা কি দাগ বসান শুরু করল?
এদিকে, মার্কিন বয়ান এলো, সামরিক অভিযান করা চলবেনা; শান্তিপূর্ণউত্তরণ ঘটাতে হবে, গণতন্ত্রে; আর্থিক ও সামাজিক বদল ঘটাতে হবে।জনতারও তাই দাবী।জনতা ও মুবারক, শ্যাম ও কুল, কাকে রেখে কাকে ধরে, এক্ষেত্রে, পাল্লা ঝুঁকল, কুলে, জনতার দিকে।জনতার মুখ আল্বেরাদাই। নতুন শ্যাম?

অনেক মত বাতাসে ভাসছে, কে বা কারা নেবে দায়িত্বভার, যদি, মুবারাক গদি ছাড়েন? আল্বেরাদাই? নাকি এই সুযোগে, মুসলিম ব্রাদারহুড বা কোনও মুসলিম চরমপন্থি, ক্ষমতা দখল করে বসবে?
মাসের শেষদিন, ৩১ তারিখ, মাসিক বেতন, ব্যাংকে জমা পরল কিনা, বোঝার উপায় নেই, ইন্টারনেট নেই এখনও।এদিকে তাহ্রির স্কোয়ারে প্রতিবাদ এখনো জারী। মানুষ, সকাল সকাল বাজার থেকে, খাবার কিনে,নিয়ে, ছুটছে তাহ্রির স্কোয়ারে,  বাজার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ১২ তার মধ্যেই।এটাই এখন এখানকার, রোজকার জীবন।সকালে বাজার থেকে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করা, তারপর সারাদিন প্রতিবাদে সামিল হওয়া, রাত্রে, পালা করে, পাহারাদারি করা। অবশ্য, তাহ্রির স্কোয়ার, খালি হচ্ছে না কখনও, অনেকেই সেখানে রাতও কাটাচ্ছেন।পরদিন, অন্যরা এলে, তারা বিশ্রামে করতে ঘরে ফিরছেন।

আজ কার্ফু লাগু হল, বিকেল ৩ টে থেকে, প্রতিবাদীরা পাত্তা দিচ্ছেন না। ইতিমধ্যে, ১০০ লোক মারা গেছেন, খবরে প্রকাশ। এতলোকের জান কবুল প্রতিবাদ, আর, একজন ৮২ বছরের বৃদ্ধের গদি কবুল নয়।
এখনো, দড়ির খেলা।

অথবা, বৃদ্ধ ভদ্রলোক কি এমন, পাকেচক্রে পড়েছেন, যে ক্ষমতা ছাড়তে পারছেন না!!শুধু ক্ষমতা লোভ দিয়ে কি বিচার করা যায়? নাকি পুতুল নাচের ইতিকথা লিখছে অন্য কেউ। আগামীকাল থেকে, লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন, প্রতিবাদী জনতা।সেই সঙ্গে, জানিয়ে দিয়েছেন, আগামীকাল হবে, প্রেসিডেন্ট ভবন অভিযান।সেনাবাহিনী কেও ডাক দেওয়া হয়েছে, সঙ্গী হতে।জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, শহীদদের কফিন থাকবে মিছিলে। চরম সংঘাতের দিন কি উপস্থিত?
এদিকে, মার্কিন সাবধানী থাকলেও, যুদ্ধ বিমানের ওড়া-উড়ি কমেনি।সন্ধ্যে ঘনাচ্ছে।কুজন শোনাচ্ছে, গুলির শব্দ।

খবর পেলাম, মিসরের সরকারি বিমান সংস্থা, তাদের সমস্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্লেন, বাতিল করেছে, সমস্ত ট্রেনও বাতিল হয়েছে। এখনো পযন্ত, মোবাইল চলছে, SMS বন্ধ, ইন্টারনেট নেই। TV  চলছে। AL-JAZEERA চ্যানেল ব্যান করা হয়েছে। ধীরে ধীরে, যোগাযোগের মাধ্যম গুলিকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।আকাশে যুদ্ধ বিমান; রাজপথে, সেনা বাহিনী, ট্যাঙ্ক; থানা থেকে লুট হওয়া বন্দুক আছে অনেক মানুষের হাতে; তারা কারা, কাদের পক্ষে, সেটা এই মূহুর্তেপ্রশ্ন বটে।
তাহ্রির স্কোয়ার ঘিরে ফেলেছে, ফৌজ; ট্যাঙ্কের সংখ্যা বাড়ান হয়েছে, খবরে শুনলাম।কার্ফু জারী আছে, তবু ফৌজ, কোন বাধা দিচ্ছে না প্রতিবাদীদের, তারা যোগ দিচ্ছেন; সেনাবাহিনীর, ঘেরাটোপ পেরিয়েই তারা যাচ্ছেন, তাদের তল্লাশিও নিচ্ছেন সেনানীরা।

(৩)
আজ ১লা ফেব্রুয়ারি, প্রতিবাদীরা, মিলিওন মার্চের ডাক দিয়েছে, সেই সঙ্গে চলছে, দেশব্যাপী হরতাল, যদিও, আলাদা করে তার প্রভাব বোঝা যাচ্ছে না, কারণ গত ১ সপ্তাহ থেকেই, সমস্ত কিছু প্রায় স্তব্ধ, প্রতিবাদ ছাড়া।
সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানাল হল,জনতার বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করা হবেনা। উসাহিত করল প্রতিবাদীদের।
প্রতিবাদের কেন্দ্রস্থল, তাহ্রির স্কোয়ারে সকাল থেকেই জমায়েতের আকার বাড়ছে।
জনতা বেশীরভাগই মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যারা, ভাল পরেন, ভাল খান গোছের।তারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বেসরকারি চাকুরীজীবী, মাঝারী ব্যবসায়ী। এরা কেন ক্ষিপ্ত??

একটা হিসেবে দেখলাম, কতগুলি তথ্য
১।মিসরের ৪০% মানুষ, দারিদ্রসীমার (দৈনিক আয় ২ ডলারের নিচে) নিচে, বাস করেন ।
২।GDP > ৫%
৩।শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২৭%

এই হিসেব গুলিকে বিদ্রোহের কারণ হিসেবে দেখান হচ্ছে। আমি অর্থনীতি বিদ  বা সমাজতাত্ত্বিক নই; কিন্তু যুক্তি হিসেবে এগুলো খুব একটা গ্রহণযোগ্য মনে হল না। কারণ, বিদ্রোহ, যারা করছেন, তারা ওই ৪০% এর মধ্যে পড়েন না, তারা GDP র স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করেন। শিক্ষিত বেকার কিছু থাকতে পারেন, মাসিক বেতন নিয়ে অখুশিরাও আছেন নিশ্চয়, কিন্তু তারা সংখ্যাগুরু নন প্রতিবাদীদের মধ্যে। তাহলে এই ব্যাপ্তি কি ভাবে এত বিশাল হতে পারে?? হতে পারে, যদি, মানুষ, অন্যর জন্য নিজের স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করতে রাজী থাকেন, ইত্যাদি ইত্যাদি......এই সম্ভাবনাতেও যদিথেকে গেল।অবশ্য-ই, কিছু মানুষ, সেই রকম ভাবেন, কিন্তু সবাই নিশ্চয় নয়।হ্যাঁ, তিন দশকের পুলিশী অত্যাচার, একটা ইন্ধন বটে।এর থেকেও বড় একটা কারণ আছে।

অর্থনীতির জয়ঢাক বিশ্বায়নেরবাজনা এখানকার মানুষ, শুনছেন, কিন্তু খুব একটা চাক্ষুষ করার সুযোগ পাননি।মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যাদের অধিকাংশ মাঝারী ব্যবসায়ী, তারা পদে পদে পড়েছেন, পুলিশী জুলুমে, সরকারী আমলাদের দুর্নীতির খপ্পরে।গুটি কয়েক পুঁজিপতির একচ্ছত্র আধিপত্য, বেশীরভাগই, মুবারাক সমর্থিত।মাঝারি ব্যবসায়ীরাও চান, ফুলে ফেঁপে উঠতে, তাতে বাধা, মুবারাক ও তার প্রশাসন।কর্মচারীরাও চান, মোটা মাইনের চাকরী, যেমন করছে, ভারতের কিছু তরুণ প্রজন্ম; সহজ যুক্তি গুলি এরকম, এজন্য চাই, প্রতিযোগী বাজার, চাই আরও বৈদেশিক পূঁজি; মুষ্টিমেয়, দেশীয়, পুঁজিপতিদের হাতে, একচ্ছত্র ব্যবসা করার ক্ষমতা (হ্যাঁ, আইন প্রদত্ত ক্ষমতা, মুবারাক জামানায়)এসবের পরিপন্থী।  তাই পাল্টাও জামানা।এদিকে, বিশ্বব্যাপী, আর্থিক মন্দাও খুঁজছে নতুন পথ, নতুন বাজার, মিসর এখনো, পুরো উন্মুক্ত নয়; তাই সুযোগ এখানে বেশী।মিসরের দরজায়, কড়া নাড়া বিশ্বায়ন ও মিসরের ভেতর, “উন্নয়নএর সুযোগ খোজা, আখাঙ্খিত, মধ্যবিত্ত জনতা।এই দুইয়ের সাঁড়াশী চাপে, মুবারাক জামানা।
পশ্চিমবঙ্গে পাটিতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ত্রিশের ও বেশি সময় ধরে।মিসরে, পাটিতন্ত্র তৈরি হয়নি, ব্যক্তিতন্ত্র, পাটিকে ন্যাশত করেছে, তাই হয়ত, NDP র সদর দপ্তর পুড়ে গেল অত সহজে।



এদিকে তাহ্রির স্কোয়ারে, প্রতিবাদী জনতার সংখ্যা বেড়েই চলেছে, গণবিক্ষোভ চলছে, নেতা-হীন ভাবেই, যদিয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আছে তাদের মধ্যে, কিন্তু তাদের কথা মানুষ শোনে না, কারণ এরা মুড়িয়ে ছিলেন, মুবারক জামানায়।তাই প্রতিবাদী জনতা জানেন না, মুবারক গেলে বিকল্প কি? তারা শুধু চান মুবারক যেন বিদায় নেয়। তাহলেই, স্বপ্নপূরনের স্বপ্ন।

বিকল্পের অভাব, অনেক জায়গাতেই, শাসক গোষ্ঠীকে বহুদিন ধরে গদিতে বসিয়ে রাখে; যেমন, পশ্চিমবঙ্গে। বিকল্পের অভাব তৈরির কৃতিত্ব অবশ্য-ই শাসক গোষ্ঠীর প্রাপ্য।তবে সময়ের দাবী নতুন বিকল্পের সন্ধান দেয় বৈকি।
তাহ্রির স্কোয়ারে প্রতিবাদ চলছে সারাদিন ধরে, আওয়াজ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে।
রাত সাড়ে নটা, সি এন এন সূত্রে খবর এলো, প্রেসিডেন্ট, ওবামার বিশেষ দূত, প্রেসিডেন্ট মুবারককে, পরবতী নির্বাচনে (আগামী সেপ্টেম্বরে হবে) অংশ নিতে নিষেধ করেছেন। মুবারাক সম্মত।......ঠিক-ই, তিনি আছেন, তার অঙ্গুলি-লেহনেই, গাছের পাতা নড়ে, চন্দ্র সূর্যওঠে, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
নতুন শ্যাম নিশ্চয় খুঁজে পাওয়া গেছে, এতক্ষণে; দেখার বিষয়, কে ইনি?
হায় মুবারক!

মিশরের, ভৌগলিক অবস্থান, সুয়েজ খালের উপস্থিতি, আরব বিশ্বের তেল, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক জট; সব মিলিয়ে, মিশর, আমেরিকার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং এই দায়িত্বগুলি, প্রেসিডেন্ট মুবারাক ভালভাবেই পালন করছিলেন; যা, আমেরিকাকে স্বস্তি দিচ্ছিল।তাই মার্কিন কৃপাও ছিল; আর্থিক সাহায্য ছিল, যার বেশিরভাগটাই (১.২ বিলিয়ন ডলার) সামরিক ক্ষেত্রে; মধ্যপ্রাচ্যের জট সামলানতে যার বিশেষ ভূমিকা আছে, নিঃসন্দেহে। নতুন বাজার খোলার দাবী, হয়ত, এই মূহুর্তেআরও বেশি জোরাল।

রাত সাড়ে দশটা, মুবারক, নিজ-মুখে, ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন আগামী ৮ মাসের মেয়াদ কালে এবং আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন না, জানিয়ে দিলেন, আরবিতে।
ম বারক মচকালেন, ভাঙলেন। জনতার দাবী পূরণ হল না।জনতা অখুশি, স্লোগান দিচ্ছে, মুবারক, এই মূহুর্তেবিদায় হও। রাত দেড়টা, প্রতিবাদ কিছুটা স্তিমিত, কিন্তু স্তব্ধ নয়।সুদূর আমেরিকা থেকে ওবামা সাহেব বাতাদিলেন, উত্তরণ ঘটাতে হবে, এক্ষণ-ই। মানে বিদেয় হও, মুবারক। ঘাড় ধাক্কা পরলও।

কিন্তু একি, একদল মুবারাক সমর্থনকারী দল দেখা যাচ্ছে, প্রতিবাদী জনতার মধ্যে।মানে, জল আরও গড়াবে।
২রা ফেব্রুয়ারি, সকাল বেলা আপিস থেকে জানাল, আমার ফেরার সূচি ঠিক হয়ে গেছে, বিকেলের বিমানে মুম্বাই, ফিরবো।সকাল সকাল তল্পি তল্পা বেধে, বেড়িয়ে পড়লাম, নিরাপত্তার ঘেরাটোপে, পথে অগুনতি কামানের উপস্থিতি যুদ্ধক্ষেত্র চেনালও।



মেরা মহান ভারত আমায়ও অন্যান্য ভারতীয় এমন কি মাল-দ্বীপবাসীকে মুম্বাই নিয়ে এসেছে আসছে, ৪৫ হাজার নগদের বিনিময়। যেটা জেনে খারাপ লাগলো, বহু ভারতীয় শ্রমিক আটকে পরেছেন, তারা ঐ টাকা দিতে পারছেন না বলে, তাদের মালিক রাও হয়ত দায়িত্ব এরাচ্ছেন।অনেক ইউরোপীয় দেশ শুনলাম, সরকারী খরচে, দেশের লোককে দেশে ফেরাচ্ছে।

(লেখক পেশায় জিওফিজিসিস্ট {Ggeophysicist}। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানী সংস্থার কাজে মিশরে গিয়েছিলেন)